গ্রন্থ পর্যালোচনা/ প্রত্যয়ী যাত্রা

শামসুল হক শামস্‌

কাব্যমনস্ক বিবেকী সত্তার মানুষ, সত্য সাধনায় অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসের নির্ভীক ব্যক্তিত্ব শফিকুল ইসলাম। আলোচিতব্য কাব্যগ্রন্থ ‘প্রত্যয়ী যাত্রা’ তারই সাম্প্রতিক প্রয়াস। তার নিরলস প্রয়াস প্রমাণ করে যে, তার অপ্রতিরোধ্য গতি থামবার নয়, অন্যায়ের কাছে মিথ্যার কাছে আপোষ করবার মত নয়। আর তার নিরন্তর চেষ্টার মাঝে তিনি তার অনন্য কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন বলেই প্রতিভাত হয়।

বাহুল্য শব্দের অলংকার,অনুপ্রাস বিবর্জিত আধুনিক সাহিত্য মূলতঃ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে বাংলাদেশ দিয়ে তার রক্তাক্ত অভিযাত্রা আরম্ভ করে। এই অভিযাত্রায় যারা কাব্য চর্চ্চা করে খ্যাতিমান তারা অনেক। তাদের মাঝে লেখালেখির সাথে জড়িত বহুদিন ধরে প্রত্যয়ী যাত্রা-র কবি শফিকুল ইসলাম।

কবি শফিকুল ইসলাম শুধু কবি নন, তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার। তার কাব্য প্রতিভা আর গীতিকার সত্তার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সুরেলা ছন্দে রচিত প্রত্যয়ী যাত্রা গ্রন্থটি প্রাঞ্জল ভাষার এক অনবদ্য সৃষ্টি।

কোন দেশ বা জাতির নিপীড়িত মানুষের কষ্ট কান্না বঞ্চনার চিত্র দেখে কখনো কোন বিবেকবান সচেতন মানুষ স্থির থাকতে পারে না। প্রকৃত অর্থে যারা কবি তারা বিবেকের তাড়নায় মজলুমের সঙ্গে আরম্ভ করেন লেখার সংগ্রাম। আলোচ্য প্রত্যয়ী যাত্রা গ্রন্থে অনলবর্ষী শব্দে রচিত সর্বমোট তেত্রিশটি সাবলীল কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতাগুলো গীতিকবিতার আঙ্গিকে রচিত বিধায় প্রত্যয়ী যাত্রা গ্রন্থটি মূলতঃ অধিকার বঞ্চিত মেহনতী মানুষের গীতাঞ্জলী।

জীবনের যন্ত্রণায় মানুষ যখন অতিষ্ঠ হয়ে যায় তখন সে তার অধিকার আদায়ের ব্রতে নেমে আসে প্রকাশ্য রাজপথে। আর কবির কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে থাকেঃ–

আমরা এবার নেমেছি পথে

আখিজলে নয় বুকের শোণিতে

অনেক দুঃখে ও যন্ত্রণাতে

জয় করে নিতে বৈরী জীবনটাকে।

(প্রত্যয়ী যাত্রা)

সত্য দাবীর কাছে অন্যায় চিরদিন পরাজিত। এই বিশ্বাস এই প্রত্যয় যে যাত্রীর সে এ-ও জানে যে তার অভিষ্ট লক্ষ্য কি। আর তখন সে নিশ্চিত করে বলতে পারেঃ–

আমাদের লক্ষ্য আছে জানা

আমরা কজন ভয়ভীতি মানিনা,

উদ্যত মৃত্যুকে পরোয়া করি না-

এগিয়ে যাবো দ্বিধাহীন আলোর-পথযাত্রী।

(সামনে অসীম আধার-কালো রাত্রি)

প্রত্যয়ী যাত্রা গ্রন্থে বিপ্লবী আদর্শে, লক্ষ্যে ও চেতনায় রচিত ছাব্বিশটি কবিতা ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত এক একটি জাগরণী শ্লোগান এবং বাংলা সাহিত্যের জন্যে এক অমূল্য সম্পদ। বাকী সাতটি কবিতার মাঝে ফুটে উঠেছে এ দেশের প্রাণকেন্দ্র এ দেশের রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত শহুরে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষোভ আর মনস্তাপ। যেমন ‘ঢাকার গান’ কবিতায় আছে-

কত লোক আসে যায় এখানে

আপন আপন ভাগ্যের অণ্বেষণে,

কেউ দুর্ভাগ্য নিয়ে ফিরে যায়

কারো ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা।

(ঢাকার গান)

আরো বঞ্চনা আরো কষ্টের চিত্র খুজে পাই ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ কবিতায়-

এখানে আলোর নীচে জমে অন্ধকার

উচু প্রাসাদ ইমারতের সাথে

পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে বস্তির সমাহার।

(ঢাকা আমার ঢাকা)

সমাজে বঞ্চিত শোষিত মানুষের কষ্ট আর বঞ্চনাকে উপজীব্য করে কবিতা লিখে অনেকে। কিন্তু বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর সত্যকে সরাসরি বলার সাহস রেখে কবিতা লিখেছে এমন কবির সংখ্যা হাতে-গুণা।

প্রত্যয়ী যাত্রা-র কবি শফিকুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে একজন ব্যতিক্রম প্রতিভা। তার অনন্য কাব্য প্রতিভা ইতোমধ্যে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন সৃষ্টি করে নিয়েছে।

[ প্রকাশক- মিজান পাবলিশার্স, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। ফোন- ৯৫১২৯৪৬, ৭১১১৪৩৬। মোবাইল- ০১৫৫২৩৯১৩৪১]এছাড়া www.rokomari.com থেকে অনলাইনে সরাসরি বইটি সংগ্রহ করা যাবে।